দাবাড় পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে খেলাটিকে নিজের ধ্যান-জ্ঞান বানিয়েছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমেদের পথ ধরেই জিয়া দাবায় এসেছিলেন। গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করে হয়েছেন দেশসেরা দাবাড়।
জিয়ার পথ অনুসরণ করে তার ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়াও এসেছেন দাবায়। ইতোমধ্যে হয়েছেন ফিদে মাস্টার। যে দাবাকে ধ্যান-জ্ঞান বানিয়েছিলেন, সেই দাবা খেলতে খেলতেই জিয়া মারা গেলেন!
শুক্রবার বিকালে পল্টস্থ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) পুরাতন ভবনে দাবা ফেডারেশনের ক্রীড়া কক্ষে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম রাউন্ডের খেলা চলাকালীন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারান গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। পরে চিকিৎসার জন্য তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো যায়নি।
এরপর সন্ধ্যায় তাকে শাহবাগের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নেয়ার পর বহু চেষ্টা করেও জিয়ার পালস খুঁজে পাননি চিকিৎসকরা। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে জিয়াউর রহমানের বয়স হয়েছিল ৫০ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে সহ অসংখ্য গুনগ্রাহী এবং আত্মীয়-স্বজন রেখে যান।
ধারণা করা হচ্ছে, খেলা চলাকালীন সময়েই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান জিয়া। চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে আর নেই বললেও, তার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য অশান্ত হয়ে পড়েন এবং অন্য হাসপাতালে নেয়ার উদ্যোগ নেন। ফেডারেশন ও দাবাড়ুরা তাকে কয়েক দফা বোঝান। এক ঘণ্টা পর তিনি ও তার পরিবার আশ্বস্ত হলে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়।
জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম রাউন্ডের খেলায় শুক্রবার গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের বিপক্ষে খেলছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া। খেলায় ভালো পজিশনেই ছিলেন তিনি। বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে হঠাৎ-ই দাবা ফেডারেশনের রুমে দুই দাবাড়ু শাকিল ও নাইম হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে জানান, ‘জিয়া ভাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।’ সবাই ধরাধরি করে জিয়াকে পঞ্চম তলা থেকে নিচে নামিয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার রাজীবের গাড়িতে করে ৯ মিনিটের ব্যবধানে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নিয়ে যান। মিনিট দশেকের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে যায় গাড়ি।
হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকেরা দ্রুতই জিয়ার চিকিৎসা শুরু করেন। সাধারণত ৫ মিনিট অপেক্ষা করা হলেও জিয়ার জন্য চিকিৎসকরা ২০ মিনিট চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা তার পালস খুঁজে পাননি। কিছুক্ষণ পরই খবর আসে, জিয়া আর নেই। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন জিয়া।
১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণকারী গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন তিনি। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) খেতাব পান জিয়া। নিয়াজ মোর্শেদের পর ২০০২ সালে দেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টারের (জিএম) খেতাব অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে প্রথমবার জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এই টুর্নামেন্টে রেকর্ড ১৪ বারের চ্যাম্পিয়নও তিনি। যেখানে বাকি চার গ্র্যান্ডমাস্টার সম্মিলিতভাবে জিতেছেন ১৬ বার। ৪৪তম দাবা অলিম্পিয়াডে ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়ার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ২০২২ সালে তারাই বনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পিতা-পুত্র জুটি, যারা জাতীয় দাবা দলে ছিলেন।
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। হঠাৎ তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়ায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ), দাবা ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস কমিউনিটি (বিএসজেসি)। এক শোক বার্তায় তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনাসহ তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে।