নারীর গৃহস্থালী কাজের আর্থিক মূল্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরূপন ও স্বীকৃতি, সরকারিভাবে ডে-কেয়ার সেন্টার, কর্মজীবি নারী হোস্টেল নির্মাণ এবং নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাজেট বরাদ্দের দাবিতে আজ ২৩ মে ২০২৪ দুপুর ১২ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে অর্থমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রকৌশলী শম্পা বসু। বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি দীপালি রাণী, সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ মনীষা চক্রবর্ত্তী, দপ্তর সম্পাদক রুখশানা আফরোজ আশা, অর্থ সম্পাদক কোহিনূর আক্তার কনা, ঢাকা নগর শাখার সভাপতি সেলিনা ইয়াসমিন কনা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ। সমাবেশ পরিচালনা করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. দিলরূবা নূরী। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা রওশন আরা রুশো, নূরজাহান ঝর্ণা।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোন কাজ নেই যার ফলাফল নেই। কাজ সেটা ছোট হোক বা বড় হোক তার প্রভাব পড়বেই। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যে কাজের ফলাফল ছাড়া দৈনন্দিন জীবন অচল হয়ে পড়ে। মানুষের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে কিন্তু সে কাজ হলো এমন ধরণের কাজ যার কোন স্বীকৃতি নেই, যে কাজের মর্যাদা নেই এমনকি যে কাজকে তাচ্ছিল্য করা হয় সবসময় আর যারা এই কাজ করেন তাদের কোন পারিশ্রমিক নেই। এই স্বীকৃতিবিহীন, মর্যাদাবিহীন, মজুরীবিহীন কাজের নাম গৃহস্থালি কাজ। এইসব কাজের ৮০ ভাগের বেশি করেন নারীরা। উদয়াস্ত ক্লান্তিকর এই গৃহস্থালি কাজ ছাড়া সমাজ ও পরিবার টিকে থাকা অসম্ভব। নারীর কাজের অর্থনৈতিক অবদান প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমতঃ মজুরীর বিনিময়ে কাজ এবং টাকা উপার্জনের জন্য স্বনিয়োজিত কাজ, যা জিডিপির হিসাবে যুক্ত হয়। দ্বিতীয়তঃ নারীর মজুরীবিহীন কিছু পারিবারিক কাজ যেমন হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল পালন করে বিক্রি করা ইত্যাদি, এর আর্থিক মুল্য জিডিপিতে যুক্ত হয়। তৃতীয়তঃ নারীর গৃহস্থালি কাজ, যার বাজার মুল্য বা বিনিময় মুল্য নেই, যা বাজারজাত করা যায় না তা জিডিপিতে যুক্ত হয় না এমন কি শ্রম শক্তি হিসেবেও গণ্য হয় না।
পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই বলে পরিবারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে গৃহিনী নারীদের অংশগ্রহণ তার স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যরা খুব একটা গ্রহণ করেন না। অর্থাৎ সংসারে নারীদের দায়িত্ব যত আছে অধিকার সে পরিমানে নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমান সম্পত্তি ভাগ করার আইন আছে। অর্থাৎ যদি ২০ বছর সংসার করার পর কোন স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাহলে এই ২০ বছরে সৃষ্ট মোট সম্পত্তি সমান সমান ভাগ হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো সংসার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক-মানসিক শ্রম থাকা সত্তে¡ও নারীরা স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সম্পত্তির প্রায় কোন অংশই পান না। ফলে গৃহিনীরা অসহায় হয়ে পড়েন। অনেক সময় আর্থিক নিশ্চিয়তা নেই বলে অনেকে অত্যাচারিত হয়েও স্বামীর সাথে থাকতে বাধ্য হন। অথচ বিয়ের পর ঐ সংসারের যা কিছু সম্পদ-সম্পত্তি অর্জিত হয়েছে গৃহিনী নারীরও সেখানে পরিপূরক ভূমিকা আছে। গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য নিরূপণ ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকলে পরিবারের ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হতো। পারিবারিক নির্যাতনও কমতো।’
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ‘বাজেট শুধু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, বাজেটের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীও প্রতিফলিত হয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর অগ্রযাত্রার সাথে দেশের এগিয়ে যাওয়াও যুক্ত। অথচ আমাদের দেশে প্রতি বছর যে জেন্ডার বাজেট হয় তা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১ শতাংশের মতো যা মূলত বিভিন্ন ভাতা প্রদানেই সীমাবদ্ধ। ভাতাগুলোর পরিমাণও খুব সামান্য। যেসব কারণে নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসতে পারেন না বা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝড়ে পড়েন, ঐসব বাধাগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য বাজেটে তেমন কোন বরাদ্দ থাকে না। সরকারি উদ্যোগে উপজেলায় উপজেলায় ডে-কেয়ার সেন্টার ও কর্মজীবি নারী হোস্টেল নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দ করলে অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারে। নারীবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, মাতৃসদনে পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য খুব বেশি বাজেট বরাদ্দ লাগে না। কিন্তু এগুলোতে সরকারের মনোযোগ খুব কম।’নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ‘সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম মনে করে নারীর সম অধিকার নিশ্চিত করা এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সমাজে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে যেসকল প্রতিবন্ধকতা তা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সেসকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে। পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর শ্রমের অবদানের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।’