কোটা সংস্কার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে যখন উত্তাল দেশ, তখন বন্ধুদের সঙ্গে মেসেঞ্জার গ্রুপে পরিকল্পনা করে আন্দোলনে অংশ নেন নাফিসা হোসেন মারওয়া। দিনের পর দিন ছিলেন রাজপথে, কিন্তু তার বাবা এসবের কিছুই জানতেন না। যখন জানলেন তখন তার কলিজার টুকরা মেয়ে নাম লিখিয়েছেন শহীদের তালিকায়। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সাভারের একমাত্র নারী শহীদ নাফিসা তার বাবাকে ফাঁকি দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
দুই বোনের মধ্যে বড় নাফিসা টঙ্গীর দত্তপাড়ার সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ছোট বোন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা চা দোকানি আবুল হোসেন এবং মা কুয়েতপ্রবাসী কুলসুম বেগম। তাদের পরিবার টঙ্গীর এরশাদনগরে একটি ছোট্ট বাসায় ভাড়া থাকে।
নাফিসার বাবা জানান, গত ২৮ জুলাই সাভারে ছোট মামার বাসায় যান নাফিসা। সেখানে গিয়েও মামাদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গণআন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন। ৫ আগস্ট সকালে আন্দোলনে অংশ যোগ দিতে যাওয়ার সময় মামারা তাকে বাধা দেন। কিন্তু কোনো বাধাই নাফিসাকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। মামাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দেন।
ওইদিন দুপুরে বাবাকে ফোন দিয়ে নাফিসা বলেন, ‘আব্বু, হাসিনা পলাইছে।’ তখন তার বাবা বিরক্ত স্বরে বলেন, ‘হাসিনা পলাইছে তাতে তোর কী? তুই বাসায় যা।’ নাফিসার জবাব ছিল, ‘আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সময় নাই, আব্বু। আল্লাহ যা কপালে রেখেছে তা-ই হবে।’ এর কিছুক্ষণ পর সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজার সামনে ঘাতকের গুলি নিস্তব্ধ করে দেয় হাসিনার ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের সাহসী সৈনিক নাফিসাকে। একটি বুলেট তার বুকের এক পাশ থেকে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
গুরুতর অবস্থায় নাফিসাকে প্রথমে স্থানীয় ল্যাবজোন হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে নাফিসাকে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নাফিসা। মৃত্যুর আগে নাফিসা বাবাকে বলেছিলেন, ‘আব্বু, আমি মারা গেলে লাশটা নিয়া যাইও।’
নাফিসার মামা হযরত আলী বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ নাফিসা হল’ রাখার দাবি জানাচ্ছি আমরা। এটি তার আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর একটি উপযুক্ত উপায় হবে।’ আদরের মেয়ে নাফিসার শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে কুয়েত থেকে দেশে এসেছিলেন মা কুলসুম বেগম। মেয়েকে হারিয়ে তার কান্না থামছেই না। গত নভেম্বরে কুয়েত ফিরে যাওয়ার আগে স্বজনদের কাছে তিনি বলেছেন, ‘নাফিসার স্বপ্নপূরণের জন্য বিদেশে গেলাম আর সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তবে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য ও জীবন দিয়েছে এ জন্য আমি গর্বিত।’
নাফিসার মামা হযরত আলীর চোখে ভাসে সেই জেদি ও সাহসী ভাগনির মুখ। তিনি বলেন, ‘ও (নাফিসা) সবার মধ্যে আলাদা ছিল। ওর মধ্যে ছিল এক অন্যরকম জেদ আর সাহস। আমি ওর জন্য গর্বিত।’
জানা যায়, মৃত্যুর পর আন্দোলনকারীদের সহায়তায় নাফিসার লাশ টঙ্গীর এরশাদনগরের বাসায় নেওয়া হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
সম্প্রতি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ‘নাফিসা হোসেন মারওয়া শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র’ নামে একটি ডে কেয়ার সেন্টার উদ্বোধন করেছে। এ ছাড়া কোর্টবাড়ী এলাকায় তার স্মরণে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।
শহীদ নাফিসার বাবা জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের ২ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ছোটবোনের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের জন্য নাফিসার আত্মত্যাগ কিছুটা হলেও সার্থক হবে বলে মনে করে তার পরিবার। তারা সরকারের কাছে শহীদ নাফিসার ছোটবোনের শিক্ষার খরচ ও ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানে সহযোগিতা কামনা করেছেন।
নাফিসার মৃত্যু তার বাবার জীবনে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এসএসসিতে মেধাবী ফলাফল এবং এইচএসসিতে ৪.২৫ জিপিএ পাওয়া নাফিসার জন্য বাবা-মায়ের অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। শেষ ফোনে মেয়ের বলা কথাগুলো এখনো তার কানে বাজে। মনে হয় যেন নাফিসা এই মাত্র তার সঙ্গে কথা বলল। মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে একটাই কথা ছিল, ‘মেয়েটা পাস করল, কিন্তু রেজাল্টটা দেখল না।’
নাফিসার মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪৭ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় এ মামলাটি করেন। তিনি তার মেয়ের ঘাতকদের কঠোর বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
নাফিসার পরিবার মনে করছে, তার আত্মত্যাগ আজীবন এ দেশের মানুষকে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জোগাবে, এ দেশের মানুষের মুক্তির পথ তৈরি করে দেবে। তার এই আত্মত্যাগ শোষণ, বঞ্চনা, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এ দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে।