কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনের আলোচিত সেই আবাসনের সেপটিক ট্যাংক থেকে গতকাল বিকেলে কিছু খণ্ডিত মাংস পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশের ধারণা, এগুলো এমপি আনারের হতে পারে। ঢাকার ডিবি পুলিশপ্রধান হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রাপ্ত মাংসখণ্ডগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। এরপর নিশ্চিত করে বলা যাবে এগুলো এমপি আনারের শরীরের অংশ কিনা।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার সঞ্জিবা গার্ডেনের ওই আবাসনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন।
তদন্তের কাজে কলকাতা অবস্থানকালে বাংলাদেশের ডিবি পুলিশপ্রধান হারুন অর রশিদের অনুরোধে সেই ফ্ল্যাটের টয়লেটের সঙ্গে যুক্ত সেপটিক ট্যাংক ভেঙে তল্লাশিকালে এসব খণ্ডিত মাংস পাওয়া যায়। এসব মাংসের ওজন ৪ কেজির মতো হবে বলে জানা গেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আরও তল্লাশি চলছিল। সেপটিক ট্যাংক তল্লাশি করার সময় কলকাতার সিআইডির একটি টিমের সদস্যরা ওই মাংস ও কিছু চুল পেয়েছেন। সেপটিক ট্যাংক তল্লাশির সময় ঢাকার ডিবি কর্মকর্তারা সেখানে ছিলেন না। বাংলাদেশ মিশন সূত্রও এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি সূত্র জানায়, কসাই জিহাদ মাংস কেটে তার সঙ্গে থাকা ছোট ওজনযন্ত্রে কয়েকটি মাংসের টুকরা ওজন করে দেখেও নিয়েছিলেন। একেকটি মাংসের টুকরোর ওজন ছিল ৭০ থেকে ১০০ গ্রাম। আনারের মাথা আধখানা করে তাও টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয়। জিহাদের দাবি, মাথার টুকরো অন্য দুই অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল অন্য টুকরোর সঙ্গে ট্রলিতে পুরেছিলেন। তারা ওই টুকরোগুলো বনগাঁ সীমান্তের কাছে যশোর রোডের ওপর ফেলে দেন।
এর আগে এমপি হত্যাকাণ্ডে নতুন করে দুটি জায়গায় তল্লাশি করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সিআইডিকে অনুরোধ করেন ঢাকার ডিবির গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। একটি জায়গা হচ্ছে সঞ্জিবা গার্ডেন আবাসনসংলগ্ন জলাশয়। আর দ্বিতীয়টি হলো টয়লেট চেম্বার। ডিবির প্রধান হারুন অর রশিদ সিআইডিকে ওই ফ্ল্যাটের সুয়ারেজ পাইপ ভাঙার পাশাপাশি হাতিশালা ব্রিজের নিচের খালটি সার্চ করতে অনুরোধ করেন।
সে অনুযায়ী আবাসনের নিকাশি পাইপ, সেপটিক ট্যাংক তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা হয়। আবাসনের বাথরুমের পাইপ খুলে পরীক্ষা করা হয়। কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মীরা জঙ্গল সাফ করে খোঁজাখুঁজি করেন সঞ্জিবা গার্ডেনের আশপাশে।
উল্লেখ্য, ঢাকায় গ্রেপ্তার আমানুল্লাহ গত সোমবার এবং গতকাল মঙ্গলবার দুই বাংলার যৌথ তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, এমপি আনারের দেহের কিছু অংশ তারা কমোডে ফেলে বারবার ফ্ল্যাশ করেছেন।
এদিকে গতকাল এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, সিআইডি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে তথ্য মিলেছে, তার সঙ্গে এখানকার তথ্যপ্রমাণ, গ্রেপ্তারদের বয়ান মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া একাধিক ডিজিটাল প্রমাণ হাতে এসেছে। তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হারুন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিনজনের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে এখানে ধরা পড়া আসামির সাক্ষ্য মিলিয়ে দেখছি। শনাক্তকরণের কাজ বিস্তারিতভাবেই চলছে। আমাদের হাতে ইতোমধ্যে যা তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, তাতে এই অপরাধীদের সাজা দিতে বেগ পেতে হবে না।’
এদিকে গতকালই এমপি আনার খুনের মূল ষড়যন্ত্রকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন, সিয়াম ও মুস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিশ জারি করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। তবে এখনই কসাই জিহাদকে হেফাজতে নিচ্ছে না ডিবি। হারুন বলেন, পরে প্রয়োজনমতো তাকে হেফাজতে নেওয়া হতে পারে।
গতকাল নিউ টাউনের অ্যাক্সিস মলের একাধিক দোকানে যায় দুই দেশের গোয়েন্দা দল। ইতোমধ্যে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, খুনের আগে বেশ কিছুদিন নিউ টাউনের একটি হোটেলে ছিলেন সন্দেহভাজনরা। সেখান থেকে ওই শপিং মলে গিয়ে বিভিন্ন জিনিস কিনেছিলেন তারা।
এ পর্যন্ত সিআইডির কাছে আসা তথ্য অনুসারে, কলকাতার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ের রাস্তায় বাগজোলা খালের কৃষ্ণমাটি ব্রিজের কাছে ফেলা হয়েছিল আনারের দেহাংশ। তার মোবাইল ফোন এবং পোশাক ফেলা হয় গাবতলা বাজারের কাছে। তার মাথার খুলি টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল শাসনের কাছে একটি ভেড়িতে। সোমবার ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে খুনের দিনের ঘটনার রিক্রিয়েট বা পুনর্নির্মাণ করান সিআইডির তদন্তকারীরা।
সেখানেই এই কথা জানান কসাই জিহাদ। সেই মতো গতকাল সকাল থেকেই ভাঙড়ের পোলেরহাটসংলগ্ন জিরানগাছা, কৃষ্ণমাটি এলাকায় জিহাদকে সঙ্গে নিয়ে আবার নতুন করে ওই ঘটনার পুনর্নির্মাণ করেন পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি এবং ঢাকার ডিবির কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে চলে রুটিন তল্লাশিও। ড্রোন, ডুবুরি, মৎস্যজীবী, বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগের সাহায্য নিয়ে চলে দিনভর তল্লাশি।
সিআইডি সূত্রের খবর, খুনের দিন দুপুরে ফয়সাল ও আমানুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে সঞ্জিবা গার্ডেন আবাসনের ফ্ল্যাটে ঢোকেন আনার। দোতলার ফ্ল্যাটের ওপর তলার ঘরে তখন ছিলেন খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার শিলাস্তি রহমান। বাইরে জুতা খুলে এই তিনজন ঢোকেন ফ্ল্যাটে। নিচের ঘরে তখন উপস্থিত ছিলেন জিহাদ ও সিয়াম ওরফে সাইম। জিহাদ অর্থাৎ যাকে দিয়ে আনারের দেহ টুকরো টুকরো করে হয়েছিল, তার বয়ান অনুযায়ী এমনই তথ্য পেয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দারা।
সিআইডি আরও জানায়, জিহাদের বর্ণনা থেকে জানা গেছে, ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলা হয় সংসদ সদস্যকে। এরপর শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। রান্নাঘরসংলগ্ন একটা তাকে হলওয়েতে খুন করে আততায়ীরা। দুই দেশের গোয়েন্দা অফিসারদের উপস্থিতিতে জিহাদ জানান, সেই জায়গায় একটি সিসিটিভিও ছিল, যেটিকে আগে থেকেই কাপড় এবং লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন শিলাস্তি রহমান। খুন করার পর সোজা রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয় দেহ। সেখানেই টুকরো টুকরো করা হয়। দেহ থেকে হাড় মাংস আলাদা করে পৃথক প্যাকেটে ঢোকানো হয়।
শিলাস্তি ঢাকায় ডিবির জেরায় বলেছিলেন, সে সময়টা তিনি ওপরে ছিলেন। নেমে এসে আর দেখেননি আনারকে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গোয়েন্দারা বলছেন, বিকেল ৪টা নাগাদ আনারের জুতা, যেটা বাইরে খোলা ছিল, সেটা আততায়ীরা ভেতরে নিয়ে যান। খুনের ঘটনার পুনর্নির্মাণ-প্রক্রিয়া চলাকালীন ঢাকায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সঙ্গেও কথা বলেন তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দাদের দাবি, সিয়াম আনারের সিম কার্ড নিয়ে পালিয়ে যান নেপালে। নিজের মোবাইলে বার কয়েক অ্যাক্টিভও করেন। তাই মুজাফফরপুরে আনারের মোবাইল অ্যাকটিভ পাওয়া গিয়েছিল।
সিআইডির তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গেছে, ট্রলিতে আনারের হলুদমাখা দেহের টুকরো প্রথমে ফেলা হয়েছিল নিউ টাউনের একটি পাবলিক টয়লেটে। খুনের মূল অভিযুক্ত বাংলাদেশের কুখ্যাত সুপার কিলার আমানুল্লাহ ওই পাবলিক টয়লেটেই তার সঙ্গী জিহাদ হাওলাদারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওই ট্রলি। সোমবার জিহাদকে সঙ্গে নিয়ে ওই পাবলিক টয়লেটেও যান বাংলাদেশের গোয়েন্দারা।
খুনের ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময় ফ্ল্যাটে বসেই বাংলাদেশের গোয়েন্দাকর্তা হারুন অর রশিদ ভিডিও কল করে মূল অভিযুক্ত আমানুল্লাহকে ঘটনাস্থল দেখিয়ে প্রশ্ন করেন। আমানুল্লাহ ও জিহাদের বয়ান যাচাই করেন তারা।
গত ১৩ মে খুন ও দেহাংশ টুকরো করার পর আমানুল্লাহ, জিহাদ ও সিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে দেহের টুকরোভর্তি ট্রলি নিয়ে আবাসন থেকে গাড়ি করে বের হন। আবাসন থেকে কিছুটা দূরে একটি পাবলিক টয়লেটে জিহাদের হাতে ওই ট্রলি তুলে দিয়ে আবার ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন আমানুল্লাহ। জিহাদ অন্য একটি গাড়িতে ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি গ্রাম, পোলেরহাটের বাগজোলা খাল, রাজারহাটের একটি ভেড়িতে দেহাংশ ফেলে দেন।