বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক ও উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। প্রতি নির্বাচনী মৌসুমে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উত্তপ্ত হয়ে ওঠে-বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে।
ইতিহাস, বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করলে স্পষ্ট হয়, দেশের গণতন্ত্র এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ঝলক
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সরকার এসেছে এবং গেছে-কখনও নির্বাচনের মাধ্যমে, কখনও সামরিক হস্তক্ষেপে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর নির্বাচন নিয়মিত হলেও, প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক চরিত্র। ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ও ভোটগ্রহণের পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
২০২৪ সালের নির্বাচন ও বর্তমান পরিস্থিতি
সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়েও দেশজুড়ে বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে, ফলস্বরূপ অনেক আসনে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জয়ী হন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণেও উত্থাপিত হয় ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন। সরকার দাবি করে নির্বাচন ছিল সংবিধান অনুযায়ী ও শান্তিপূর্ণ, কিন্তু ভিন্নমত পোষণ করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন: পুরনো দাবি, নতুন বাস্তবতা
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলগুলোর দাবির কেন্দ্রবিন্দু ছিল অন্তর্বর্তীকালীন বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। অবশেষে ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অভ্যন্তরীণ চাপ, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যস্থতায় গঠিত হয় একটি আপসনির্ভর অন্তর্বর্তী সরকার।
২০২৫ সালের শুরুতে একদল টেকনোক্র্যাট ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই সরকারের মূল দায়িত্ব:
নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান
সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
নিরপেক্ষ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা
ইভিএম ও ব্যালটের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার নির্ধারণ
এই অন্তর্বর্তী সরকার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ, সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দেওয়ার ঘোষণা।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
সরকারপন্থী ও বিরোধী-উভয় পক্ষই এই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা মেনে নিলেও বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ রয়েই গেছে। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের আগে বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের আরও রদবদলের দাবি তুলেছে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ বলছে-অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা শুধুই নির্বাচনকালীন সহায়ক, নীতিনির্ধারক নয়।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ইভিএম ও ব্যালটের মিশ্র ব্যবস্থার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এবং মাঠপর্যায়ে প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা ও অংশগ্রহণ
আশাব্যঞ্জকভাবে, নতুন প্রক্রিয়ায় জনগণের আগ্রহ ও আস্থার কিছুটা পুনরুজ্জীবন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে ভোটদানের আগ্রহ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়, তবে গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদ্যোগকে ‘সতর্ক আশাবাদ’ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ সফল হলে ভবিষ্যতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কাঠামো গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত হতে পারে।