Site icon দৈনিক টার্গেট

দুই সন্তান নিয়ে সংগ্রামরত সাহিদা সুলতানা: মগবাজারে চাকরির পাশাপাশি আইন পড়ছেন

দুই সন্তানের জননী সাহিদা সুলতানার দিন শুরু হয় ভোর ৫টায়। বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে স্কুলের প্রস্তুতি, সকালের খাবার, তারপর ছুটে চলা রাজধানীর ব্যস্ত মগবাজারে- যেখানে তিনি আদ দীন হাসপাতালের একজন রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করেন।

রান্না, শিশুদের স্কুলের প্রস্তুতি, অফিসের শিফট- এসবের মধ্যে আইনের বই খোলার সময় বের করা তার জন্য রীতিমত যুদ্ধ। চাকরির পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি প্রোগ্রাম শেষ করেছেন।

“ক্লান্তিতে চোখ ঢুলে এলেও মনে করি, আইনজীবী হয়ে যেন নারীর অধিকার নিয়ে লড়াই করতে পারি।” সাহিদা সুলতানা

তার বড় ছেলে সাদ একাদশ শ্রেণিতে পড়ে, আর ছোট ছেলে সায়েম হাফিজিয়া মাদ্রাসায়। সারা দিন হাসপাতালে কাজ শেষে তিনি বাসায় ফিরে সন্তানদের পড়াশোনায় বসেন। কখনো কখনো রাত জেগে বিভিন্ন লেখালেখি করেও বাড়তি কিছু রোজগার করেন। স্বামী তিন বছর আগেই তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন, জীবনের সব বোঝা তার কাঁধে চেপে পড়ে। ছেলেরা বলেন – আমরা মায়ের সাথে রান্নাঘরে সাহায্য করি এবং একসাথে বাজার করতে যাই। এতে মায়ের কষ্টটা যেমন কমে, তেমনি আমাদের মধ্যে কথাও বেশি হয়। মাকে বোঝাতে গিয়ে আমরা নিজেরাও ধৈর্য ধরতে শিখি।

“আমি চাই ওদের পড়াশোনাটা থামিয়ে না দিই। ওরা যেন মানুষ হয়। আমি কষ্ট করে হলেও তা করব, “হাসপাতালে ডাক্তার ও রোগীদের সাথে সারাদিন থাকি, কিন্তু স্বপ্ন দেখি আমার সন্তানরা একদিন বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হবে এবং চাকরি করে আমার দুঃখ ঘোচাবে।” সাহিদা সুলতানা।

আদ-দীন হসপিটাল কর্তৃপক্ষ তার সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়ে নমনীয় শিফট ও জরুরি অবস্থায় ছুটির সুযোগ দেয়। ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন, সহকর্মী আমেনা আক্তার ও মনি বলেন- “তিনি আমাদের প্রেরণা। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল কর্মী হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। রোগীদের সেবায় তিনি সবসময় আন্তরিক, সময়নিষ্ঠ এবং পেশা-দারিত্বের পরিচয় দেন। চাপের মধ্যেও তিনি সুশৃঙ্খলভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারেন। সহকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ দক্ষতা এবং রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব তাকে একটি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিবে।

সমাজের একাংশ তার আইন পড়াকে “অনাবশ্যক” বলে সমালোচনা করে। প্রতিবেশী রুবিনা অবশ্যই ভিন্ন মত পোষণ করেন- “ওর মতো মেয়েদের জন্যই আমাদের মেয়েরা এগোবে।”

সাহিদার লক্ষ্য ফ্যামিলি কোর্টের আইনজীবী হয়ে নিপীড়িত নারীদের সহায়তা করা, জজ কোর্টে ইন্টার্নশিপ করা এবং নারী ও শিশু অধিকার সংক্রান্ত মামলায় বিশেষজ্ঞ হওয়া।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী: দেশে ২২ লাখ একক মাতা, যাদের ৬৮% দৈনিক আয় ২০০ টাকার নিচে। এদের মধ্যে মাত্র ৭% স্নাতক বা তার সমতুল্য ডিগ্রিধারী।

সাহিদা সুলতানার বাস্তবধর্মী গল্প শুধু ব্যক্তিগত সংগ্রাম নয়, এটি সমাজের সকল বাধাকে অতিক্রমের দলিল। তার সাফল্য প্রমাণ করে- শিক্ষা ও সংকল্প থাকলে নারীরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারেন। তার পথচলা দেশের লক্ষ নারী-পুরুষের সমান অধিকারের পথকে আরও প্রসারিত করছে। সাহিদার এই লড়াই আমাদের সমাজের অনেক একক নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি। সমাজের জন্য এমন নারীরা যেন একটি জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, বাসাভাড়া এবং স্কুল ফি মেটানো-সব মিলিয়ে সাহিদার জীবন চলে হিমশিম খেয়ে। তবু তিনি দমে যান না। এই ধরনের নারীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। রাষ্ট্র, সমাজ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যদি এগিয়ে আসে, সাহিদার মতো অনেক নারী ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

“আমার ছেলেরা যেন একদিন বলতে পারে, আমাদের মা শুধু রান্না করেননি- সে আইন দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন।” সাহিদা সুলতানা।

Exit mobile version