আজ (৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৫ সালে ইউনেসকোর উদ্যোগে প্রবর্তিত এই দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৬৬ সালে, আর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার তা উদযাপিত হয় ১৯৭২ সালে।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য “প্রযুক্তির যুগে সাক্ষরতার প্রসার” যা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
সাক্ষরতার বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪) অনুযায়ী, ৭ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৭.৯ শতাংশ। অর্থাৎ এখনও প্রায় ২২.১ শতাংশ মানুষ পড়তে-লিখতে অক্ষম। এদের মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু, ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরী এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ।
শিক্ষাবিদদের মতে, এই হার বাস্তবে আরও কম হতে পারে। তাদের অভিযোগ, সরকারি পরিসংখ্যানে অনেক সময় প্রকৃত বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় না। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ মৌলিক পড়া-লেখা কিংবা সংখ্যা চিনতে পারে না, ফলে প্রকৃত সাক্ষরতা অর্জন অধরাই থেকে যায়।
দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা: অদৃশ্য বন্ধন
দেশের সাক্ষরতার অন্যতম প্রধান অন্তরায় দারিদ্র্য। স্বাধীনতার সময় সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬.৮ শতাংশ, আর দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৮০ শতাংশ মানুষ। বর্তমানে সাক্ষরতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭.৯ শতাংশে এবং দারিদ্র্যসীমার হার নেমেছে ২৮ শতাংশে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দারিদ্র্যের হার ফের বেড়েছে সরকারি হিসেবে যা ২০২২ সালে ছিল ১৮.৭ শতাংশ, তা ২০২৫ সালের মে মাসে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৮ শতাংশে। চরম দারিদ্র্যে ভোগা মানুষের সংখ্যা এখন ৯ শতাংশেরও বেশি।
অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পরিবারগুলো শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে কাজে যুক্ত করছে। এতে নিরক্ষরতার চক্র ভাঙা কঠিন হয়ে পড়ছে।
জেলাভিত্তিক বাস্তবতা
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাক্ষরতার অগ্রগতি সমানভাবে ঘটেনি। এখনো ১৮টি জেলায় নিরক্ষর মানুষের হার ২৫ শতাংশের বেশি। পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ সেখানে ৬৫.৩ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। ময়মনসিংহের জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা এবং উত্তরের কুড়িগ্রামেও নিরক্ষরতার হার তুলনামূলক বেশি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব এলাকায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে পর্যাপ্ত অবকাঠামো, দক্ষ জনবল, কার্যকর উপবৃত্তি এবং বিশেষ পরিকল্পনা জরুরি।
প্রযুক্তিনির্ভর সাক্ষরতার চাহিদা
আজকের বিশ্বে সাক্ষরতার সংজ্ঞা কেবল পড়তে ও লিখতে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তথ্য বিশ্লেষণ, গণনা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতাও এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, প্রকৃত সাক্ষরতা মানে হলো ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারা।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বার্তায় বলেন, “প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে দক্ষতাভিত্তিক ও কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।”
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা
২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সাক্ষরতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বটে, কিন্তু প্রকৃত মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা নিশ্চিত করতে এখনো অনেক পথ বাকি। দারিদ্র্য হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রসার ছাড়া টেকসই অগ্রগতি সম্ভব নয়।