২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের রাত এখনও দুঃস্বপ্নের মতো ভর করে আছে বাগেরহাটের উপকূলীয় শরণখোলার মানুষের মনোজগতে। সেদিনের সুপার সাইক্লোন সিডর মুহূর্তেই গিলে খেয়েছিল হাজারো প্রাণ, ধ্বংস করে দিয়েছিল ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদিপশু সবকিছু। বিশেষত শরণখোলা তখন পরিণত হয়েছিল লাশের স্তূপে; সেই ভয়াবহতার স্মৃতি ১৭ বছর পরও ভুলতে পারেনি এখানকার মানুষ।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!সেদিন রাতে বলেশ্বর নদী ভেঙে পড়া দুর্বল বেড়িবাঁধ উপচে পুরো সাউথখালীসহ আশপাশের গ্রামগুলোকে করে তুলেছিল ধ্বংসস্তূপ। এখনও স্বজনহারা মানুষের কান্না, ভাসমান লাশ আর ভাঙা ঘরের সেই দৃশ্য এখানকার মানুষের মনে গেঁথে আছে দগদগে ক্ষতের মতো।
৩০০ কোটি টাকার বাঁধ দুই বছরের মাথায় ঝুঁকিতে সিডরের প্রায় এক দশক পর ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চীনা প্রতিষ্ঠান সিএইচডব্লিউআই কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। তিন বছরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতা, বিলম্ব ও সংশোধনীতে সময় লেগে যায় প্রায় সাত বছর।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাঁধ হস্তান্তর করা হলেও মাত্র দুই বছরের মধ্যে পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করেছে। বগী থেকে মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে, অন্তত ১১টি জায়গায় সিসি ব্লক ধসে পড়েছে, আর কয়েকটি স্থানে ভাঙন পৌঁছে গেছে মূল বাঁধের গায়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীশাসন ছাড়া এ ধরনের উঁচু বাঁধ স্থায়ী হয় না। সম্ভাব্যতা যাচাই ও টেকনিক্যাল নকশায় বড় ধরনের ঘাটতি ছিল বলেও তাদের অভিমত।
স্থানীয়দের ক্ষোভ: “বাঁধ আছে, কিন্তু নিরাপত্তা নেই”
গাবতলা ও দক্ষিণ সাউথখালী এলাকার বাসিন্দারা জানান, সিডরের পর তারা বারবার টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি জানিয়েছিলেন। তাদের অভিযোগ বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো হলেও এর স্থায়িত্ব নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
স্থানীয় মিজান হাওলাদার বলেন, “সিডরে স্বজন হারানোর পর ভয়টা আজও কাটেনি। নতুন বাঁধকে ভরসা মনে করেছিলাম, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ভাঙতে শুরু করল।”
আরেকজন জাহাঙ্গীর খান বলেন, “নদীশাসন ছাড়া যতই উঁচু বাঁধ করা হোক, নদীর ঢেউ একসময় না একসময় ধ্বংস করে দেবে।”
দুর্নীতির অভিযোগ: “মাটি বাদ দিয়ে নদীর বালু দিয়ে বাঁধ করলে টিকবে কিভাবে?”
শরণখোলা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। তার অভিযোগ বাঁধের বহু অংশে মাটির বদলে বালু ব্যবহার করা হয়েছে, যা উচ্চ জোয়ার ও নদীর প্রবল স্রোত সহ্য করতে পারে না।
তিনি বলেন, “অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত আর দুর্নীতির কারণে জনগণের টাকা নষ্ট হয়েছে। নদীশাসন ছাড়া এই বাঁধ টিকবে না দুই-তিন বছরের মধ্যেই পুরোটা ধসে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।”
তিনি সরকারের কাছে দ্রুত তদন্ত ও জরুরি নদীশাসনের দাবি জানান। জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভাঙনের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে জরুরি কাজ শুরু করেছে। নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বগী এলাকার প্রায় ৭০০ মিটার এবং ফাশিয়াতলা এলাকার কিছু অংশে বালুভর্তি জিও ব্যাগ, সিসি ব্লক ও ডাম্পিং কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এক হাজার মিটার এলাকা প্রাথমিকভাবে রক্ষা করার চেষ্টা চলছে। এসব কাজ শেষ হলে জলোচ্ছ্বাসে অন্তত তাৎক্ষণিক ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব হবে।”
তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন এই জরুরি মেরামত কতদিন টিকবে, আর বড় কোনো ঝড় উঠলে শরণখোলার মানুষ কি আবারও সেই ২০০৭ সালের রাতে ফিরে যাবে?
সিডরের ১৭ বছর পার হলেও উপকূলের মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। হাজার কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণের পরও ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটছে শরণখোলাবাসীর। টেকসই নদীশাসন ছাড়া স্থায়ী নিরাপত্তা আসবে না—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা।
দৈনিক টার্গেট 





















